ইতিহাসের চতুর্থ ব্যক্তি হিসেবে আকাশে উড়েন হেজারফেন আহমেদ চেলেবি।১৬৩০ সালে গালাটা টাওয়ার থেকে ঝাপ দিয়ে তিনি প্রায় ১০ মিনিটের মতো বসফরাসের উপর ভেসেছিলেন। তাঁর ভাই হাসান চেলেবি ১৬৩৩ সালে সফলভাবে রকেট উৎক্ষেপণ করেন। এই দুই ভাই উড়োজাহাজ আবিষ্কার করে পৃথিবীটাকেই পালটে দিয়েছিলো
শিল্পীর তুলিতে উড়ন্ত হেজারফেন আহমেদ চেলেবি
দুই ভাই, নাম হেজারফেন আহমেদ চেলেবি ও লাজারি হাসান চেলেবি। দুজনই ইস্তানবুলের বাসিন্দা এবং বিজ্ঞানী। তারা চাইতো সবসময়ই নতুন কিছু করতে। আর দুজনেরই স্বপ্ন এক ছিলো – আকাশে উড়া। এবং দুজনই তাদের এই স্বপ্ন পূরণ করে, যদিও দুজনের স্বপ্ন পূরণের পথ আলাদা ছিলো।
হেজারফেনের আসল নাম অবশ্য ভিন্ন ছিলো। তাকে হেজারফেন নাম দিয়েছিলো পরিব্রাজক ইভলিয়া চেলেবি। হেজার শব্দটা এসেছে ফার্সি শব্দ ‘হাজার’ থেকে যার অর্থ ‘সহস্র’। ফেন হচ্ছে আরবি শব্দ যার অর্থ ‘বিজ্ঞান’। হেজারফেন শব্দের অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘সহস্র বিজ্ঞান’ বা এককথায় বহুবিদ্যাজ্ঞ (Polymath). ইভলিয়া চেলেবি তার লেখায় হেজারফেনের আকাশে উড়ার প্রচেষ্টা সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। হেজারফেন প্রথমদিকে পাখিদের উড়ার গতি ও ধরণ পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। তারপর ঈগলের পাখা দিয়ে নিজের জন্য বৃহৎ এক পাখা বানিয়ে তা দিয়ে আট-নয় বার শহরের ওকমেইদানিতে উড়ার চেষ্টা করেন কিন্তু তা যথাপযুক্ত ছিলো না। পরে তিনি বুঝতে পারেন উড়ার জন্য দরকার উচ্চতর স্থান এবং প্রচণ্ড বাতাসের বেগ। হেজারফেন এবার উড়ার জন্য ইস্তানবুলের গালাতা টাওয়ারকে বেঁছে নেন। আনুমানিক ১৬৩০-১৬৩২ সালের মধ্যে হেজারফেন আহমেদ চেলেবি উড়ার জন্য তার আবিষ্কৃত গ্লাইডার ব্যবহার করে গালাতা টাওয়ার থেকে লাফ দেন এবং বাতাসের স্রোত ব্যবহার করে উড়তে থাকেন। ইস্তানবুল শহরের অনেক মানুষ তা পর্যবেক্ষণ করেন। তৎকালীন অটোম্যান সুলতান চতুর্থ মুরাদ রাজকর্মচারী সিনান পাশার বাসভবন থেকে হেজারফেনের এই উড়া প্রত্যক্ষ করেন। শহরের গালাতা থেকে হেজারফেন বাতাসের সাহায্যে উড়ে শহরের পূর্বপ্রান্তে উস্কুদারের দোগানসিলার স্কোয়ারে পৌঁছে যান।
হেজারফেনের আকাশে উড়ার পর শহরবাসীর মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। সুলতান মুরাদ হেজারফেনকে এক থলে স্বর্ণমুদ্রা পুরষ্কার দিয়ে বলেন, “এটা খুব ভীতিকর। সে (হেজারফেন) তার নিজের ইচ্ছামতো যা খুশি তাই করতে পারে। এ ধরণের মানুষকে রাখা উচিত হবে না।” তারপর সুলতান হেজারফেনকে আলজেরিয়ায় নির্বাসনে পাঠান। হেজারফেন আর ইস্তানবুলে ফিরতে পারেননি, স্বাভাবিকভাবে সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। এছাড়াও চেস্টারের বিশপ জন উইলকিন্স ১৬৪৮ সালে অস্ট্রিয়ার সাবেক রাষ্ট্রদূত ওগিয়ার ঘিলসেলিন দে বুসবেককে কোন এক তুর্কির ইস্তানবুলের উড়ার প্রচেষ্টা সম্পর্কে জানান। কিন্তু অবাক করার মতো ব্যাপার হচ্ছে সুলতানের তথ্যভান্ডারে হেজারফেনের উড়ার সম্পর্কে কোন তথ্যই নেই।
লাজারি হাসান চেলেবি, হেজারফেনের ভাই এবং বিজ্ঞানী। তারও ইচ্ছা ছিলো উড়ার, তবে সেটা ভিন্নভাবে। তিনি উড়ার জন্য কোন যন্ত্র আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন যার মাধ্যমে আকাশে উড়া সম্ভব হবে। ইভলিয়া চেলেবির ভাষ্যমতে হেজারফেনের আকাশে উড়ার এক বছর পর ১৬৩৪ সালে লাজারি হাসান চেলেবি ১৪০ পাউন্ড বারুদ ব্যবহার করে সাত পাখা বিশিষ্ট একটা রকেট তৈরি করেন। ইস্তানবুলের তোপকাপি প্রাসাদের কাছে সারায়বুরনুতে তিনি এই রকেট লঞ্চ করার পরিকল্পনা করেন। ইভলিয়া চেলেবির লেখা থেকে জানা যায়, রকেট লঞ্চ করার আগে লাজারি সুলতান মুরাদের উদ্দেশ্যে বলেন, “জাহাপনা! ভালো থাকবেন। আমি হজরত ইসা (আঃ) সাথে কথা বলতে যাচ্ছি।” লাজারি রকেটে চড়ে আকাশে উড়েন। সেউ রকেট আকাশে উড়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। তীরে পৌঁছে সুলতানকে মজা করে তিনি বলেন, “ও আমার সুলতান, হজরত ইসা (আঃ) আপনাকে সালাম জানিয়েছেন।” সুলতান তাকে পুরষ্কৃত করে সেনাবাহিনীর সিপাহী পদে নিয়োগ করেন।
তুর্কি সরকার হেজারফেন আহমেদ চেলেবির সম্মানে ইস্তানবুলের একটা বিমানবন্দর নামকরণ করে। ১৯৯৬ সালে দুই ভাইয়ের জীবনি নিয়ে ‘ইস্তানবুল কানাতলারিমিন আল্টিন্দা’ নামে এক চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। এছাড়াও কয়েকবছর আগে অটোম্যান সুলতানদের ও সুলতান আহমেদের স্ত্রী কোসেম সুলতানের জীবনি নিয়ে নির্মিত ঐতিহাসিক ধারাবাহিক নাটক ‘মুসতেহেম ইউজিল : কোসেম’ এ ইভলিয়া চেলেবি ও হেজারফেন আহমেদ চেলেবি এ দুটি চরিত্রকে উপস্থাপন করা হয়।