গণতন্ত্রকে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সর্বোত্তম শাসনপ্রণালী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে জনগণের মতামতই রাষ্ট্র পরিচালনার প্রধান ভিত্তি। "জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, জনগণের শাসন"এই মূলমন্ত্রকে ধারণ করে গণতন্ত্র এগিয়ে চলে।
এটি এমন একটি পদ্ধতি যেখানে জনগণ সরাসরি বা প্রতিনিধির মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ করে। তবে প্রশ্ন থেকেই যায় জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ মত সবসময় কি সঠিক সিদ্ধান্ত দেয়?
তবে বাস্তবতা বলছে, গণতন্ত্র সবসময় প্রত্যাশিত ফল দিতে পারে না। কখনো কখনো এই ব্যবস্থা অযোগ্য, অশিক্ষিত এবং অনৈতিক ব্যক্তিকে ক্ষমতায় পৌঁছে দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এই প্রবন্ধে আমরা গণতন্ত্রের এই দিকটি এবং একটি বিকল্প যোগ্যতাভিত্তিক শাসনব্যবস্থার কার্যকারিতা আলোচনা করব, যা ইসলামিক খেলাফত পদ্ধতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। এই পদ্ধতিতে নেতৃত্বের ভিত্তি ও যোগ্যতা, তাকওয়া, জ্ঞান ও ন্যায়বিচার।
প্রেক্ষাপট ১: গণতন্ত্রের ব্যর্থ প্রতিচ্ছবি
ধরা যাক, একটি রাষ্ট্রে দুইজন ব্যক্তি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। একজন শিক্ষিত, মেধাবী, বিচক্ষণ এবং দেশের উন্নয়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অন্যজন অপরাধপ্রবণ, অশিক্ষিত এবং সমাজে সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত। বাস্তবে দেখা গেল দ্বিতীয় ব্যক্তি জিতে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হলো। ফলাফল স্বরূপ রাষ্ট্র দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ল, প্রশাসন দুর্বল হলো এবং জনগণের জীবনমান নিম্নগামী হলো।
এই চিত্রটি গণতন্ত্রের একটি অন্তর্নিহিত সমস্যাকে সামনে আনে। গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতই চূড়ান্ত, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যদি সচেতন না হয়, তবে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণের আশঙ্কা থেকেই যায়।
গণতন্ত্রের মূল শক্তি হলো জনগণের স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকার। কিন্তু এর দুর্বল দিকগুলোও স্পষ্ট:
জনসাধারণের রাজনৈতিক অজ্ঞতা অনেক সময় অযোগ্য নেতৃত্বকে ক্ষমতায় নিয়ে আসে। অর্থ, প্রচারণা ও মিডিয়ার প্রভাব জনগণের মত পরিবর্তন করতে পারে। জনপ্রিয়তা ও আবেগের উপর ভিত্তি করে ভোট প্রদান হয়, ফলে দূরদর্শী নেতৃত্ব পেছনে পড়ে যায়।
ফলে অনেক সময় এমন মানুষ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে, যারা দুর্নীতিগ্রস্ত, অযোগ্য বা নীতিহীন—যার ফলে রাষ্ট্র ও জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
প্রেক্ষাপট ২: যোগ্যতাভিত্তিক শাসন :
এই প্রেক্ষাপটে ধরা যাক, একদল বিচক্ষণ ও শিক্ষিত মানুষ একটি বোর্ড গঠন করে এবং রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একজন জ্ঞানী, মেধাবী ও দক্ষ ব্যক্তিকে নির্বাচিত করে। এই পদ্ধতিতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব এমন কাউকে দেওয়া হয়, যিনি—জ্ঞানী ও বিচক্ষণ,নেতৃত্বের গুণাবলীসম্পন্ন, এবং জনকল্যাণে আন্তরিকভাবে নিবেদিত।
এই ব্যবস্থায় নির্বাচন হয় না গণভোটের মাধ্যমে, বরং একটি নিরপেক্ষ ও জ্ঞানী পরিষদ—যেমন একটি আহলে হিল্ল ওয়াল আকদ ( أهل الحل والعقد)
(জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ পরামর্শদাতা পরিষদ)—সিদ্ধান্ত নেয় কে সবচেয়ে যোগ্য।
এই ব্যবস্থা ইসলামের প্রাথমিক খেলাফত ব্যবস্থার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
ইসলামিক খেলাফতের মূলনীতি:
খেলাফত শব্দটি এসেছে ‘খলিফা’ থেকে, যার অর্থ প্রতিনিধি বা দায়িত্বপ্রাপ্ত। ইসলামে খলিফা হচ্ছেন এমন ব্যক্তি, যিনি আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী সমাজ পরিচালনা করেন। খেলাফতের বৈশিষ্ট্য:
১. যোগ্যতা ও তাকওয়ার ভিত্তিতে নির্বাচন:
খলিফা নির্বাচিত হন উম্মাহর মধ্যে সবচেয়ে যোগ্য, নীতিবান, এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মধ্য থেকে।
২. শূরা বা পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্ত:
রাষ্ট্র পরিচালনায় পরামর্শ গ্রহণ আবশ্যিক (সূরা আশ-শূরা: ৩৮)।
৩. ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা:
ব্যক্তিগত লাভের পরিবর্তে জনগণের কল্যাণ ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করাই মুখ্য।
৪. শাসকের জবাবদিহিতা:
খলিফা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ; এমনকি সাধারণ মুসলমানও তাকে প্রশ্ন করতে পারে।
হযরত আবু বকর (রাঃ), হযরত ওমর (রাঃ) প্রমুখ খলিফারা ছিলেন এই ব্যবস্থার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাদের শাসনামলে নেতৃত্ব নির্ধারিত হয়েছিল যোগ্যতা ও তাকওয়ার ভিত্তিতে— যে কারণে খুলাফায়ে রাশেদীনের সময়কে বলা হয় ইসলামের সোনালী যুগ। ইসলামের শিক্ষা ও রাসূল (স:) দেখানোর পথ অনুসরণ অনুকরণ হল মানব জাতির মুক্তির পথ।
সফলতার দৃষ্টান্ত:
ইসলামিক খেলাফতের প্রথম যুগে খুলাফায়ে রাশেদীন নেতৃত্বে আসা প্রতিটি খলিফা ছিলেন:
আল্লাহভীরু ও আমানতদার,প্রশাসনিক দক্ষতাসম্পন্ন,
এবং জনগণের সেবায় নিয়োজিত।
ফলে ইসলামিক সাম্রাজ্য দ্রুত বিস্তার লাভ করে, এবং শান্তি, ইনসাফ ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। গরিব ও ধনী, মুসলিম ও অমুসলিম—সবার অধিকার রক্ষা পেত। খেলাফত ছিল নেতৃত্বের প্রকৃত আদর্শ মডেল।
গণতন্ত্র একটি শক্তিশালী প্রক্রিয়া, কিন্তু বাস্তবতায় এটি অনেক সময় ভুল নেতৃত্বকে সামনে আনে। অপরদিকে, যোগ্যতাভিত্তিক শাসনব্যবস্থা যোগ্য, সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দেয়। এর ফলে সমাজে ইনসাফ, স্থিতিশীলতা, কল্যাণ ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা পায়।
সর্বোত্তম ব্যবস্থা হতে পারে ইসলামিক মূল্যবোধ ও যোগ্যতার মানদণ্ডের মাধ্যমে যোগ্য ব্যক্তিকে নির্বাচিত করা, যেখানে নেতৃত্ব নির্বাচনের পূর্বে প্রার্থীর চরিত্র, জ্ঞান ও আল্লাহভীতি মূল্যায়ন করা হবে। সেক্ষেত্রে আমরা একটি ভারসাম্যপূর্ণ, মানবিক ও আলোকিত রাষ্ট্র গঠনে সক্ষম হব।